Skip to main content

Gilgamas

পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেস সুমেরিও সভ্যতায় গড়ে ওঠা সমাজে,আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে,এক অনামি কবির হাতে কিউনিফর্ম ভাষায় রচিত হয় গিলগামেস মহাকাব্য। যেকোন মহাকাব্যই একটি সমাজ জীবনের পরিপ্রক্ষিতে রচিত হয়েছে। বহু বছর ধরে কাহিনীগুলি মানুষের মুখে মুখে বাহিত হতে থাকে। লিখিত আকারের মধ্যেও এর মূল চরিত্রগুলি এক থাকলেও,সময়ভেদে এবং অন্চলভেদে কাহিনীর মধ্যে কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যদিও মূল কাঠামোর কোন পরিবর্তন হয় না। যে সমাজকে কেন্দ্র করে কাহিনী গড়ে ওঠে, তার স্বরূপটি খুঁজে পেতে তাই অসুবিধা হয় না। গিলগামেসের কাহিনীও ঠিক এরকমই একটি।সর্বপ্রথম ব্রিটিস মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে অস্টিন হেনরি লেয়ার্ড, ১৮৫০ সাল নাগাদ, বর্তমান ইরাকে খনন কার্য চালিয়ে প্রাচীন সুমেরিও সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিস্কার করেন। তিনি কিউনিফর্ম ভাষায় লিখিত প্রায় ২০,০০০ মাটির ট্যাবলেট বা টালি ব্রিটিস মিউজিয়ামে পাঠান। শুরু হয় অ্যাসিরিওলজির উপর গবেষনা। কিউনিফর্মভাষার পাঠোদ্ধারের কাজ। পরে আরো অনেক উৎস থেকে প্রায় ৭৫,০০০ এই ধরনের ট্যাবলেট ম্যানিস্ক্রিপ্টউদ্ধার হয়। যার মধ্যে অনেকগুলিই ভাঙা-চোরা। কিউনিফর্ম ভাষা পড়তে পারে হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। তুলনায় ট্যাবলেট ম্যানিস্ক্রিপ্টের সংখ্যা এত বেশি যে, আজো পাঠোদ্ধারের কাজ চলছে। এরকমই কিছু ট্যাবলেট ম্যানিস্ক্রিপ্টথেকে একটি ধারাবাহিক কাহিনী গিলগামেসের পাঠোদ্ধার হয়। ১৮৭০ সালে সর্বপ্রথম জর্জ স্মিথ গিলগামেসের ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। গবেষনাক্রমাগত চলছে। ১৯৬০ সালে ইরাকি আর্কিওলজিস্ট তাহা বাকির কিউনিফর্ম ভাষা থেকে গিলগামেসের একটি আরবি অনুবাদ প্রকাশ করেন। সর্বশেষ ২০০৩ সালে অ্যানড্রু জর্জ দুই খণ্ডে বিশদ আলোচিত একটি ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।এবার আসি গিলগামেসের কাহিনী প্রসঙ্গে। ব্যাবিলনের উরুক প্রদেশের রাজা গিলগামেস। দেবী মাতা ও মানুষ পিতার সন্তান গিলগামেস। তার দুই তৃতীয়াংশ স্বত্ত্বা দেব আর এক তৃতীয়াংশ মানুষ। গিলগামেস অতীব সুন্দর, ক্ষমতাবান এবং চন্চল। কিন্তু রাজা হিসাবে সে অত্যাচারী। নারীরা বিপর্যস্ত গিলগামেসের অবিমিশ্র লালসার শিকার হয়ে। প্রজার অত্তিষ্ঠ হয়ে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাবার জন্য। দেবতারা এনকিডুকে পাঠাল। এনকিডু, গিলগামেসের মতই শক্তিধর, সুন্দর কিন্তু শান্ত এবং স্থিতধ্বী। লড়াই এর মাধ্যমেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল দুজনের। এনকিডুর প্রভাবে পরিবর্তন হতে থাকল গিলগামেসের চরিত্রের। দিন চলতে থাকল। দুই বন্ধুতে মিলে একদিন হত্যা করল সিডার জঙ্গলের রক্ষক হুম্বাবাকে। গিলগামেসের বীরত্ব দেখে দেবী ইশতার তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্ত গিলগামেস তাকে বহুভোগ্যা বলে প্রত্যাক্ষাণ করে। এতে দেবী ইশতার ক্ষেপে গিয়ে তার বাবা আনুকে বলে স্বর্গের ষাঁড়টিকে মর্তে পাঠিয়ে ধ্বংসলীলা চালাতে। কিন্তু গিলগামেস আর এনকিডু মিলে স্বর্গের ষাঁড়টিকেও মেরে ফেলে। কিন্তু এতে দেবতারা রুষ্ট হয়ে তাদের শাস্তি দেয়। রোগভোগে এনকিডুর মৃত্যু হয়, আর এনকিডুর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পডে গিলগামেস। সে এক চরম সত্যের মুখামুখি এসে দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে, এইভাবে তারও একদিন মৃত্যু হবে। সে জানতে পারে উতনাপিশতমের কাছে আছে অমর হবার ওষুধ। শুরু হয় তার অমৃতের সন্ধানে যাত্রা। অর্ধ-দেবী সিদুরির মাধ্যমে তার পরিচয় হয় উর্সনাবির সঙ্গে। উর্সনাবি একজন নাবিক। সে গভীর এক জঙ্গল পার করে, প্রায় সমুদ্রের মত এক নদী পার করে গিলগামেসকে নিয়ে যায় উতনাপিশতমের কাছে, যে জানে অমৃতের সন্ধান। কিন্তু উতনাপিশতম কিছুতেই গিলগামেসকে অমৃতের সন্ধান দিতে রাজি হয় না। গিলগামেসও নাছোডবান্দা। অবশেষে উতনাপিশতমের নির্দেশেই উর্সনাবি, গিলগামেসকে নিয়ে গেল এক নদীর তটে। যে নদীতে স্নান করে ঐ তটেই জলের মধ্যে একটি ছোট্ট গাছের পল্লব খেলে অমরত্ব লাভ করা যাবে। গিলগামেস স্নান সেরে উঠতেই দেখতে পেল একটি সাপ ঐ পল্লবটি খেয়ে খোলস ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ উতনাপিশতম তাকে সঠিক গাছেরই সন্ধান দিয়েছিল। কিন্তু তা গিলগামেসের হাতছাডা হয়ে গেল।গিলগামেস মনের দু:খে উর্সনাবিকে বলল উরুক ফেরত নিয়ে চল। উরুক ফিরে এসে গিলগামেস দেখল মানুষ শান্তি এবং সমৃদ্ধির জীবন যাপন করছে। অনেক মানুষ ইতিমধ্যে মারা গেছে কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্ম জীবনকে এগিয়ে চলেছে সফলতার সঙ্গে। মরণশীল মানুষের জীবনকে মেনে নিয়ে গিলগামেস আবার রাজ্য শাসনে মনোনিবেশ করল।এবার তার সুশাসনের কথা দূর দুরান্তে ছড়িয়ে পড়ল। পরিনত বয়সে গিলগামেসের মৃত্যু হল। এবার দেখা যাক, এই মহাকাব্য থেকে তৎকালীন সমাজ সম্পর্কে আমরা কি ধারনা করতে পারি।গিলগামেসের মা একজন দেবী। তাই সে দুই তৃতীয়াংশ দেব স্বত্ত্বার অধিকারী। আবার দেবী ইশতার যে কিনা প্রজননের দেবী, গিলগামেসকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে তাকে বহুভোগ্যা বলে প্রত্যাক্ষাণ করে। এ সকল কিছু থেকে ধরা যেতে পারে গিলগামেসের কাহিনী এমন এক সমাজ ব্যাবস্থায় রচিত যেখানে মাতৃতন্ত্র ছিল ভাঙনের পর্যায়ে, আর সেই ভাঙনের উপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল পিতৃতন্ত্র।গিলগামেস দুই তৃতীয়াংশে দেবতা হলেও দেবতার অমরত্বে তার কোন অধিকার নেই। গিলগামেসের চাওয়া পাওয়া পুরোটাই মানবিক। সে স্বৈরচারী, কিন্তু তার আচরণ মনুষ্যচিত। যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে, গিলগামেস ছিল প্রিষ্ট-কিং।অর্থাৎ যখন রাজা বা তার শাসনতন্ত্র সমাজ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, স্বনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয় নি। ইজিপ্টে এর পরবর্তী সময়ে আবির্ভূত হয় গড-কিং। অর্থাৎ রাজা নিজেই ঈশ্বর, অমিত শক্তিধর। রাজশক্তি এই পর্যায়ে অনেক বেশি বজ্রসুকঠিন। যেটা গিলগামেসের সমাজব্যাবস্থায় ততটা নয় বলেই মনে হয়।হুম্বাবার হত্যা নিশ্চিতভাবই বলা যেতে পারে জঙ্গলে বসবাসকারী, সভ্যতার নিরিখে পিছিয়ে থাকা কোন উপজাতির উপর অধিকার বিস্তারের লড়াই।সবশেষে গিলগামেসের কাহিনী অমরত্ব অনুসন্ধানের কাহিনী। মৃত্যুর বিচ্ছেদকে মানুষ মানতে পারে নি। তাই বোধহয় মৃত্যুর পরের জীবন কল্পনা করে মানুষ তার সমাধিতে বিভিন্ন উপকরণ রাখার নিয়ম তৈরী করেছিল। কিন্তু গিলগামেসের রচয়িতা অনামি এই কবি মানুষের অমরত্বের এক অসাধারন ইঙ্গিত দিয়েছেন তার কাহিনীর শেষে। উরুক ফিরে এসে গিলগামেস দেখল অনেক ব্যাক্তি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও মানুষের সমষ্টিগত জীবন এগিয়ে চলেছে পারস্পরিক সহযোগীতায়, শান্তি এবং সমৃদ্ধির সঙ্গে। ব্যাক্তি মানুষের মৃত্যু ঘটবেই, কিন্তু সেটা ঠিক কবে, তা কারো জানা নেই। মৃত্যু সম্পর্কে একই সঙ্গে এই অনিশ্চয়তা এবং নিশ্চয়তার দ্বন্দ্বমূলক ধারনা মানুষের বিমূর্ত জ্ঞান ভাণ্ডারে এক অনিত্য সন্চয়। ব্যাক্তি জীবনের মৃত্যু হলেও তার কাজ বেঁচে থাকে সমষ্টিগত জীবনে। আর এই ভাবেই মানুষ বেঁচে থাকে পরবর্তী প্রজন্মে।

Comments

Popular posts from this blog

Rumpa bidroho

রুম্পা বিদ্রোহদক্ষিণ ভারতের গোদাবরী অঞ্চলের রুম্পা আদিবাসীদের সশস্ত্র বিদ্রোহ(১৮৭৮-১৮৮০)উনবিংশ শতকের সপ্তম দশকে মাদ্রাজ প্রদেশ জুড়ে প্রবল দুর্ভিক্ষে ৫০ লক্ষ মানুষ প্রান হারান। ১৮৭৬ এর ২৩ শে নভেম্বর অমৃত বাজার পত্রিকা এই দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে বৃটিশ শাসকের শোষন, উদাসীনতাকে দায়ী করেছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতাবাসীর কাছে দুর্ভিক্ষপীড়িতমানুষদের সাহায্যার্থে অর্থদানের আবেদন করলেও বিশেষ সাড়া পাওয়া যায়নি। এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ভেতরেই উপুর্যপরি শোষন, বনাঞ্চল সংক্রান্ত বাধানিষেধ ও করের বোঝা দক্ষিণ ভারতে পর্বত-অরন্যচারীরুম্পা আদিবাসীদের ভেতর তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।রুম্পা সম্প্রদায় ছিল গোষ্ঠীমূলক। সমাজে সব কাজই একত্রিত সিদ্ধান্তে হতো। সুতরাং সকলেই মিলিতভাবে বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেয়। এদের প্রধান নেতা ছিলেন চান্দ্রিয়া। লিংগম রেড্ডি, থুমন ধোরা প্রমুখ অন্যান্য নেতারাও বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। তারা থানা আক্রমন, অগ্নিসংযোগ, সরকারী কর্মচারীদের হত্যা ও ভদ্রাচলম, বিশাখাপত্তনম তথা পূর্ব গোদাবরী অঞ্চলে নিজেদের অধিকার কায়েম করলে সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর সাথে খন্ডযুদ্ধ হয়, উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র ও স...

Rajput history

ইতিহাসের পথ ধরে চলুন ফিরে যাই ১৭৩০ সালে। পশ্চিম রাজস্থানের মাড়োয়াড় অঞ্চলের খেজার্লি গ্রামে। আমরা ইতিহাসে পড়েছি চিরকালই রাজস্থান বিখ্যাত ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, দখল ও রক্তপাতের জন্য। কিন্তু যেটা ইতিহাসে নেই তা হল প্রকৃতি ও জীবজগৎ বাঁচিয়ে নিজেরা বেঁচে থাকার এক জীবনদর্শনও শিখিয়েছে জলহীন এই রাজপুতনা। এই হিংসার দুনিয়ায় একটি ব্যতিক্রমের মতো রয়েছে বিষ্ণোই সম্প্রদায় যারা আজও প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে বাঁচায় বিশ্বাসী। লুন্ঠন, কেড়ে খাওয়া বা ফসলের জন্য রাজ্যবিস্তারের পরম্পরার উল্টোপথে হেঁটে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে নিজেরা বাঁচার দর্শনে বিশ্বাস করাবিষ্ণোই সম্প্রদায় গাছ কেটে পরিবেশ ধ্বংসের পথে বোধহয় পৃথিবীতে প্রথমবার (ভারতে তো বটেই) রুখে দাঁড়িয়েছিল।আগে দেখে নেওয়া যাক কারা এই বিষ্ণোই সম্প্রদায়। কথিত আছে, রাজস্থানের পিপাসার গ্রামে ১৪৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জাম্বেশ্বর নামে এক ব্যক্তি। তিনিই পরবর্তীকাল প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই বিষ্ণোই সম্প্রদায়। বিষ্ণুর উপাসনা করতেন জাম্বেশ্বর। যে কারণে সম্প্রদায়ের নাম হয় বিষ্ণোই।গুরু জাম্বেশ্বর তার ভক্তদের বলেছিলেন, প্রকৃতিকে বাঁচানোর কথা। সুস্থভাবে বাঁচতে হলে যে পশু-পাখি-গাছপালারও প্...